ইয়াবা সিন্ডিকেটে ১০৩ জন; শীর্ষে আওয়ামীলীগ এমপি বদির ৩ ভাই

লিখেছেন লিখেছেন রাফসান ২৭ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:০৩:৪৬ দুপুর



সারা দেশে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ছড়িয়ে দিচ্ছে তিন শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। মাকড়সার জালের মতোই বিস্তৃত তাদের নেটওয়ার্ক। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করছে তাদের একটি অংশ। এসব চালান সংগ্রহ করছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়াসহ পাশের এলাকার কিছু প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী। তারাই রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১০৩ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ জন দেশি এবং ১৩ জন মিয়ানমারের অধিবাসী। তবে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র‌্যাবের তৎপরতার বাইরে বড় মাপের আরো দুই শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী সক্রিয় রয়েছে।

অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে টেকনাফের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তিনজনই শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত। এমপি বদির বিরুদ্ধেও টেকনাফের ইয়াবা সিন্ডিকেটকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার দাপটে এ পরিবারের সদস্যদের মতোই আরো অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী তালিকাভুক্ত হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর তথ্যমতে, ৯০ শতাংশ ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলছে। ১০ শতাংশ গ্রেপ্তার হলেও তাদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিজিবি সীমান্ত এলাকায় তৎপর ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় থেকে ১০৩ জনের ওই তালিকা ডিএনসিতে পাঠানো হয়। ডিএনসি যাচাই-বাছাইয়ের পর ওই তালিকা আবার মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এরপর তালিকা ধরে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই আছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সূত্র জানায়, এমপি বদির ছোট ভাই টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মাওলানা মুজিবুর রহমান, অন্য দুই ভাই আবদুর শুক্কুর ও আবদুল আমিনের নাম তালিকায় থাকলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডিএনসির কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, এমপি বদির কারণে টেকনাফের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছেন না তাঁরা। আর এ কারণে টেকনাফকেন্দ্রিক ইয়াবাবাণিজ্য কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তবে বদির পরিবারের দাবি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রতিপত্তির কারণে স্থানীয় প্রতিপক্ষরা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগ করছে।

এ ব্যাপারে কথা বলতে এমপি বদির তিন ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁদের পাওয়া যায়নি। তবে এমপি বদি গত শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্থানীয় একটি গ্রুপ আমাদের পরিবারকে হেয়প্রতিপন্ন করতে এসব কথা ছড়িয়েছে। আমার বাবা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। আমাদের অনেক পারিবারিক ব্যবসা আছে।' এমপি বদি অভিযোগ করেন, 'অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর নামই তালিকায় নেই। আর আমি এমপি বলে অনেকে অপকর্ম করে আমার নাম বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করে।' নিজের এলাকায় ইয়াবার আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা জানতে চাইলে বদি বলেন, 'এ ব্যাপারে বইলা লাভ নাই। এলাকায় প্রধানমন্ত্রী আসবেন। তা নিয়া আমি ব্যস্ত আছি। আপনাদের যা খুশি লেইখা দেন।'

এদিকে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের হালনাগাদ তালিকা তৈরি ও গ্রেপ্তারের ব্যাপারে ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) প্রণব কুমার নিয়োগী বলেন, 'এ ব্যাপারে আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। সব মাদক ব্যবসায়ীকেই আইনের আওতায় আনা হবে। তালিকাভুক্তদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে অভিযান অব্যাহত আছে।' র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, 'র‌্যাবই প্রথম আমিন হুদাকে গ্রেপ্তার করে দেশে ইয়াবার আগ্রাসনের ব্যাপারটি উদ্ঘাটন করে। এরপর চট্টগ্রামে খুলুকে গ্রেপ্তার করা হয় সবচেয়ে বড় চালানসহ। আমরা এখন তথ্য পাচ্ছি যে, ফেনসিডিলের দ্বিগুণ পরিমাণ ইয়াবা দেশে আসছে। আমরা অভিযান পরিচালনা করে যা ধরছি তার বাইরে থেকে যাচ্ছে আরো অনেক ইয়াবার চালান। তাই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের আওতায় আনতে র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান।'

তালিকায় ৯০ ইয়াবা ডিলার : সরকারি তালিকা অনুযায়ী টেকনাফ শহর ও আশপাশের এলাকায় ইয়াবার ব্যবসা করে টেকনাফ উপজেলার চৌধুরীপাড়ার মৃত এজাহার কোম্পানির ছেলে মজিবুর রহমান, শুক্কুর আলী ও আবদুল আমিন, জাহিদ হোসেন জাকু, লেঙ্গুরবিলের জাফর আহমেদের ছেলে মোস্তফা আহমেদ ও দিদার আহমেদ, রমজান আলী, আবুল হোসেন, শামসুল আলম, আবুল আইয়ুব আলী বাটাই, আরাফা বেগম, মেহেদী হাসান, শাহ আলম, সৈয়দ আলম, ইসমাইল হোসেন, জয়নাল আবেদীন, শামসুল আলম, তৈয়ব আলী, মাহমুদুর রহমান, নূর মোহাম্মদ, তাজুল ইসলাম, আইয়ুব, মো. হোসেন, সারোয়ার, মোহাম্মদ হোসেন, আফসার, হেলাল, নূর আহমেদ, নূর হুদা, জাফর আলম, সরোয়ার, রাজু মিয়া, মোক্তার হোসেন, শংকর মিয়া, বাবুল মিয়া, জিয়া, মোন্নাফ, রাকিব উদ্দিন, মামুন, সাকির হোসেন, জিয়াবুল ইসলাম, মোস্তাক মিয়া, আবদুল আমিন, নূর মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ, আবু তাহের, জাফর আলম, আহম্মদ উল্লাহ, হাসেম মেম্বার, হাফেজ নূরুল বাসার, রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করে ইয়াবা ব্যবসা করে জুয়েল রানা, আবদুল্লাহ, রানু বেগম, সেলিনা বেগম, ম্যানিলা, রুবি বেগম, জামাল, টেকনাফে বাহাদুর, হাসান, আবু আলম, সিদ্দিক, হাজি সালিমুল্লা, তোয়েব আলী, মঞ্জুরুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দিন, কবির হোসেন, আবদুল আমিন, আবু তাহের, সাবুল্লাহ, সৈয়দ আহম্মেদ মোরশেদ, রাশেদ, শাহজাহান, হোসেন আহম্মেদ, আবছার, সাইফুল, কামাল, দেলোয়ার, আবদুর রশিদ, মোহাম্মদ শাহ, রামেদা আক্তার, জিয়াম মিনা, সৈয়দ নূর, মো. আলম, নূর ছালাম। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের হালিশহরের কে ব্লকের মোহাম্মদ রশিদ ওরফে রশিদ খুলু ও আবু বকরের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সূত্র মতে, তালিকাভুক্ত ৯০ জনের মধ্যে ম্যানিলা, নূর মোহাম্মদ, শামসুল হুদাসহ পাঁচ-ছয়জন গ্রেপ্তারের পর এখন কারাবন্দি আছে। বাকিরা সক্রিয় রয়েছে ইয়াবাবাণিজ্যে।

ডিএনসির চট্টগ্রাম উপ-অঞ্চলের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত আমাদের অভিযানে ১২ জন তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হয়েছে। টেকনাফকেন্দ্রিক ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধে পাঁচ মাস আগে টেকনাফে একটি সার্কেল অফিস স্থাপন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আর কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে ডিএনসি।'

মিয়ানমারের ১৩ ইয়াবা ব্যবসায়ী : তালিকা অনুযায়ী সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে মিয়ানমারের শীর্ষ ১৩ ইয়াবা ব্যবসায়ী। তারা হলো- সাইফুল ইসলাম ওরফে মগা সুইবিন, আবদুল করিম, আবদুস সালাম, মহিবুলা, যুবায়ের আহমেদ, মহিবুল্লাহ, আবু আহমেদ, আবদুল মোতালেব, শাহ আলম, মংগী মগ, অং চং, মো. কামাল ও যুবাইর হোসেন। টেকনাফের স্থানীয় সূত্র মতে, তালিকাভুক্ত এসব ব্যবসায়ী ছাড়াও মিয়ানমারেরই আরো অর্ধশতাধিক ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

ডিএনসির মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, "গত বছর আমরা মিয়ানমারে গিয়ে বৈঠক করে এসেছি। সীমান্ত এলাকায় যারা ইয়াবা ব্যবসা করে, তাদের একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে। তারা (মিয়ানমার) আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এখনো তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।' তিনি আরো বলেন, 'মিয়ানামারের সঙ্গে আমাদের 'এওইউ' চুক্তি আছে। প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডসহ অনেকেই সেখানকার ইয়াবার আগ্রাসনে ভুগছে। বিষয়টিকে কেবল আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবার সমস্যা হিসেবেই দেখছি।"

আগেও ৩১ জনের তালিকা হয় : সূত্র জানায়, ২০১০ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক তালিকায় টেকনাফের শীর্ষ ৩১ ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। সেখানেও ছিল এমপি বদির দুই ভাইয়ের নাম। আবদুর শুক্কুর ওরফে শুক্কুর আলীর নাম ১৯ নম্বরে এবং ২০ নম্বরে ছিল মৌলভী মুজিবুর রহমানের নাম। একই তালিকায় ১৫ নম্বরে থাকা পিচ্চি আনোয়ার এমপি বদির আত্মীয়। সাত নম্বরে থাকা জাহেদ হোসেন জাকু বদির বাল্যবন্ধু। এরপর বিজিবির তৈরি করা ৬৯ জনের আরেকটি তালিকার দ্বিতীয় নম্বরে ছিল আবদুল আমিনের নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ১ ও ২ নম্বরে ছিল মোস্তাক আহমদ ও দিদার হোসেনের নাম। তারা টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে। জাফর আহমদ এমপি বদির একান্ত ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। ১৬ নম্বরে ছিল বদির কাছের লোক টেকনাফ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সফিক মিয়ার মেয়ের জামাই। সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সীমান্ত-২ অধিশাখার সাবেক উপসচিব খান মোহাম্মদ বিলাল স্বাক্ষরিত তালিকাটি ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। প্রতিবেদনের ছয় নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা হয় ২০০০ সালে টেকনাফের বাসিন্দা রমজান আলী ওরফে একটেল রমজান এবং শুক্কুর ওরফে বার্মাইয়া শুক্কুরের (এমপি বদির ভাই) মাধ্যমে দেশে ইয়াবা ব্যবসার সমপ্রসারণ ঘটে। পরে এদের অনুসরণ করে আরো অনেকেই ইয়াবা ব্যবসা করে এখন কোটিপতি।

তালিকার বাইরে দুই শতাধিক ডিলার : কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফ-উখিয়া থেকে ইয়াবা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর নাম এখনো প্রশাসনের তালিকাভুক্ত হয়নি। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে রাজধানীতে ইয়াবা এনে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করছে এসব ব্যবসায়ী। স্থানীয় সূত্র জানায়, কোনো রাখঢাক ছাড়াই ব্যবসা চালানোর কারণে সাইফুল করিম নামে একজন টেকনাফে ইয়াবার গডফাদার বলেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। অথচ কোনো তালিকায়ই তাঁর নাম নেই। অভিযোগ আছে, টেকনাফ থানার বেশির ভাগ ইয়াবা মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট হওয়ার পেছনে এ ব্যবসায়ীর হাত রয়েছে। টেকনাফের ইসমাইল, হানিফ, নূরুল কবির, মার্কিন, লেদা এলাকার নীলা, সৈয়দ হোসেন মেম্বার, নোয়াপাড়ার নূরুল হক ভুঁইয়া, হাবিরপাড়ার বাহাদুর, নজিপাড়ার মোহাম্মদ আলীর নামও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাঁরা সবাই টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।

( দৈনিক প্রকাশিত সংবাদপত্র সমূহ থেকে নেওয়া

)

বিষয়: বিবিধ

১৩৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File